
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ উপজেলার লালপুরে প্রাকৃতিক জলাশয়ে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ শুকিয়ে উৎপাদন করা হচ্ছে শুঁটকি। এই খাতের সাথে জড়িয়ে আছে শতাধিক স্থানীয় লোক।
লালপুর মেঘনা নদীর তীরে শতাধিক ডাঙ্গিতে (মাচায়) প্রথমে ফরমালিনমুক্ত দেশি প্রজাতির মাছ শুকিনো হয়। পরে শুকানো মাছ থেকে সিদল শুঁটকি উৎপাদন করায় এর স্বাদ যেমন আলাদা তেমনি সুনামও রয়েছে দেশ-বিদেশে।
এখান থেকে প্রতি বছর শত কোটি টাকা মূল্যের সিদল শুঁটকি বিদেশে রপ্তানি করা হয়। কিন্ত পুঁজি স্বল্পতা এবং ব্যাংক ঋণের অপর্যাপ্ততার কারণে এবং শুঁটকি সংরক্ষণ করতে না পারায় এসব প্রান্তিক শুঁটকি উৎপাদনকারীরা প্রত্যাশিত মুনাফা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। কিন্তু লাভবান হচ্ছেন মধ্যস্বত্বভোগীরা। এসব সমস্যার সমাধান ও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে প্রান্তিক উৎপাদনকারীদের ভাগ্য উন্নয়নের পাশাপশি দ্বিগুণ শুঁটকি উৎপাদন করে বছরে প্রায় ২শ কোটি টাকার শুঁটকি বিদেশে রপ্তানি করা সম্ভব্ বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা।
জানা যায়, প্রতিবছর কার্ত্তিক মাসের শুরু থেকে চৈত্র মাস পর্যন্ত আশুগঞ্জ উপজেলার লালপুরে দেশিয় প্রজাতির বিভিন্ন মাছ থেকে সিদল (চ্যাপা) ও শুকনা নামে দুই প্রকার শুঁটকি উৎপাদন করা হয়।
সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, আশুগঞ্জ উপজেলার লালপুরের মেঘনা নদীর তীরবর্তী প্রায় দেড় বর্গ কিলোমিটার এলাকায় ৬-৭ ফুট উঁচু করে বাঁশের বেত ও খুঁটি দিয়ে তৈরি করা হয়েছে প্রায় শতাধিক মাচা । জাল দিয়ে প্রতিটি মাচাই ঢেকে রাখা হয়েছে যাতে শুকাতে দেওয়া মাছগুলি পাখিরা খেতে না পারে। এসব মাচায় প্রতিদিন ভোর থেকে জেলার নবীনগর, বাঞ্চারামপুর, কিশোরগঞ্জের ভৈরবসহ পাশ্ববর্তী বিভিন্ন এলাকা থেকে নদীপথে আসতে শুরু করে দেশিয় প্রজাতির পুঁটি, সরপুঁটি, মেনি, ভেদী, আলুনি, টাকি, শোল, গজার, কেচকি, মলা, ঢেলা, চাপিলা, খইলসা, কাইক্যা, বিভিন্ন প্রজাতির বাইমসহ নানা মাছ।
স্থানীয় জেলে পল্লীর প্রায় ২শ বিভিন্ন বয়সী মেয়েরা দা, বটি নিয়ে এখানে জড়ো হতে থাকে। মাছের খাচা থেকে মাছগুলি রাখার সাথে সাথে নারীরা বসে যান সারিবদ্ধভাবে। মাছের প্রজাতি ও আকার অনুসারে পৃথক করে আলাদা আলাদাভাবে কাটতে শুরু করেন। পরে কাটা মাছগুলি নদীর পানিতে ধুয়ে মাচাতে শুকাতে দেন। ৪-৫ দিন শুকানোর পর শুকনা এবং সিদল বা চ্যাপাঁ শুঁটকির শুকনা মাছগুলি আলাদা করা হয়। শুকনা শুঁটকিগুলি সরাসারি চলে যায় বিক্রির জন্য আড়তে এবং সিদল শুকটির শুঁকনা মাছগুলিকে মাটির তৈরি এক প্রকার কলসীতে মাছের তৈল দিয়ে প্রক্রিয়াজাত করা হয়। ২-৩ মাস মটকার মুখ বন্ধ করে মাটির নিচে চাপা দিয়ে রাখার পর তৈরি হয় মুখরোচক ও ম্যালেরিয়ানাশক সিদল শুঁটকি।
জানা যায়, এখানকার শুঁটকিতে কোনো প্রকার স্বাস্থ্যহানিকর রাসায়নিক উপাদান মেশানো হয় না এবং মাছগুলিও থাকে ফরমালিনমুক্ত। ফলে উৎপাদিত শুঁটকির স্বাদ হয় আলাদা। ফলে এখানকার শুঁটকির চাহিদা দেশের ঢাকা, চট্টগ্রাম, ফেনী, নোয়াখালী, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়িইসহ পাশ্ববর্তী দেশ ভারত, মধ্যপাচ্যের বিভিন্ন দেশ এবং ইউরোপ আমেরিকায়ও এর কদর দিন দিন বাড়ছে।
এসব শুঁটকি রপ্তানি করে বছরে প্রায় শত কোটি টাকার আয় হলেও এখানকার প্রান্তিক উৎপাদনকারীদের ভাগ্যের পরিবর্তন হচ্ছে না। কারণ শুঁটকি উৎপাদনে একজন প্রান্তিক উৎপাদনকারী কমপক্ষে ৪-৫ লাখ টাকার পুঁজির প্রয়োজন কিন্ত এই পুঁজি তাদের অনেকেরই নেই। তাছাড়া সরকারি-বেসরকারি কোনো ব্যাংকই এসব প্রান্তিক উৎপাদনকারীদের জামানত ছাড়া ঋণ প্রদান করে না।
ফলে তাদের পুঁজি সংগ্রহ করতে হয় দাদন হিসাবে স্থানীয় আড়তদার বা মহাজনদের নিকট থেকে। ফলে উৎপাদিত শুঁটকি পরপরই দাদন পরিশোধ ও সংসার পরিচালনার জন্য উৎপাদিত শুঁটকি নিজেরা সংরক্ষণ করতে পারে না, কম দামে বিক্রি করে দিতে হয় আড়তদারদের নিকট। এতে মধ্যস্বত্বভোগী আড়তদাররা লাভবান হলেও প্রান্তিক উৎপাদনকারীরা মুনাফা থেকে বঞ্চিত হয়। সরকার যদি তাদের কম সুদে জামানতবিহীন ঋণ প্রদান করতো তাহলে শুঁটকি উৎপাদন দ্বিগুণ হতো এবং এসব প্রান্তিক উৎপাদনকারীদের ভাগ্যের পরিবর্তন আসতো বলে জানান প্রান্তিক উৎপাদনকারী, আড়ৎদার ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা।
লালপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. মোর্শেদ মাস্টার জানান, পুঁজির অভাবে প্রান্তিক চাষিরা তাদের ন্যায লাভ পায় না। সরকার এক্ষেত্রে তাদের ব্যাংক ঋণ দিয়ে সহযোগিতা করলে তাদের ভাগ্যের পরিবর্তনের পাশাপাশি শুঁটকি উৎপাদন দ্বিগুণ হতো।
কেএফ