মা আমি জুস খাব না

juce

juceসেজুতিকে স্কুলে দিয়ে আসা, সংসারের বাজার করা সবটাই মা একা করতেন। আমি আর ভাইয়া তখন স্কুলে। বাবা থাকতো অফিসে। যে যার জগত নিয়ে মহাব্যস্ত।

বাজার করে ফেরার পথে সেজুতিও ফিরত মায়ের সাথে। বাসায় ফেরার সময় মা প্রতিরোজ সেজুতির জন্য জুস কিনে নিতেন। মা ভাবতেন বড় দোকানের ওইসব দেশি-বিদেশি জুস ১০০ ভাগ খাঁটি। তার স্কুল ফেরত সন্তানকে ফলের রস খাওয়ালে স্বাস্থ্যটা ভাল থাকবে। তিনি ভাবতেন, অন্তত রাস্তার অন্যসব ভেজাল খাবারের চাইতে জুস ঢের ভাল।

কিন্তু সেজুতিকে নিয়ে হত মহামুশকিল। সে জুস খাবেই না। তার নাকি জুস খেলে বমি বমি ভাব হয়। কিন্তু মা ছিলেন নাছোড়বান্দা। জুস তাকে খেতেই হবে নইলে ঢুস খেতে হবে।

অগত্যা কি আর করা। সট্রতে সুরুত সুরুত করে টান দিয়ে নাকি কান্না জুড়ে সেজুতি বলত, ‘মা আমি আর জুস খাব না। জুস খেলে আমার বমি বমি লাগে।

সেজুতির মতো আমাদের দেশের অনেক শিশুই বাজারের জুস কিংবা ফ্রুট ড্রিংকস খেতে চায় না। যেসব জুস অথবা ফ্রুট ড্রিংকস বাজারে মিলে তার স্বাদ ও মান একেবারেই যাচ্ছেতাই বললেই চলে। কিন্তু বিজ্ঞাপণের বাহার দেখে বুঝার জো থাকবে না কোনটা বেশি ভেজাল কিংবা কোনটা খাঁটি।

জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ল্যাব্রটরির এক গবেষণায় তারা দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ৭টি জুস এনে গবেষণাগারে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন। এগুলোর প্রতিটিতেই মাত্রাতিরিক্ত এসিটিক এসিড পাওয়া গেছে।

একদিন ভরদুপুরে বাসে চড়ে ফার্মগেট থেকে টিএসসি যাচ্ছিলাম। বাসে সহযাত্রী হিসেবে ছিলেন বিচলিত বৃদ্ধ দম্পতি। তাদের কোনো এক আত্নীয়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাধীন ছিলেন। রোগীকে দেখতে যাবেন, কি নেবেন তারা? এ নিয়েই কথা হচ্ছিল দুজনার মধ্যে। আর পাশে বসে আমি আড়ি পেতে শুনছিলাম অগ্রজদের সরল কথোপকথন। কারওয়ান বাজার সিগন্যালে দাঁড়িয়ে পড়ল বাস। ঠান্ডা জুস, ঠান্ডা জুস বলতে বলতে এক বিক্রেতা জুসের বোতল উচিয়ে ধরছিল। বৃদ্ধটি কি মনে করে জানি চারটি জুসের বোতল একসাথে কিনে নিলেন। বোতল চারটি সহধর্মিনীর হাতে তুলে দিয়ে বললেন, রানুর লাইগা জুস লইয়া লইলাম, ফলের রস খাইলে ওর শরীরটা তাড়াতাড়ি ভালা অইব, কি কও?

বৃদ্ধা কি বলেছিল তা আমি স্পষ্ট করে শুনতে পাইনি। বোতলগুলোর দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আমি এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিতে চাইছিলাম। হায়রে দুটি সরলপ্রাণ! কতো কষ্টার্জিত পয়সা দিয়ে রোগীর জন্য বোতলভর্তি এসিডিক এসিড কিনে নিয়ে গেল।

ফ্রুট ড্রিংকস কিংবা জুসে ভেজালকারী প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সরাসরি আইন প্রয়োগের কোনো সুযোগ নেই তাই তারা ভেজালের বিষয়টি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে জানিয়ে থাকেন।

স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ সচিব এম এম নিয়াজ উদ্দিন সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিককে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এ প্রসঙ্গে বলেন, ভেজালকারীদের বিরুদ্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে অভিযান পরিচালনা করা হয়ে থাকে। যখনই এ বিষয়ে কিছু জানতে পারি তখনই আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হয়ে থাকে।

মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আ ব ম ফারুক বাজারের এসব ফ্রুট ড্রিংকস বা জুস প্রসঙ্গে বলেন, ফ্রুট ড্রিংকস বা জুসে এসিডের মাত্রা বেশি থাকলে বদহজম হয় এবং খাবারে অরুচি দেখা দেয়। বাচ্চাদের ক্ষেত্রে মুখে অরুচি বেশি হয়। ফ্রুট ড্রিংকস বা জুসে গ্যাস্ট্রিকের ঝুঁকি বেড়ে যায়।

এছাড়া কৃত্রিম রং ও সুগন্ধি সেই সাথে ক্ষতিকর সুগার লিভার এবং কিডনি উভয়কেই  ক্ষতিগ্রস্থ করে।

২০১০-১১ সালে বিএসটিআইয়ের পরীক্ষায় প্রাণ জুসে ভেজাল ধরা পড়ে। ২০১২ সালে আশুগঞ্জে, ২০১৩ সালে জামালপুর ভেজাল জুস তৈরির কারখানা সনাক্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয় প্রশাসন। ২০১৩ সালের নভেম্বরে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় ভেজাল জুসের কারখানা সিলগালা করে দেয় আদালত। এভাবে কতবার ভ্রাম্যমাণ আদালত ভেজালকারীদের সাজা দিলে আমরা জুসের বোতলে বিশুদ্ধতার নিশ্চয়তা পাব।

ক্ষমতাবানদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। তাদের জানাতে চাই, তাদের পরিবার পরিজনও যে ভেজাল জুস খাচ্ছেন না তার কি কোনো নিশ্চয়তা আছে?