দু’বছর হলো চলে গেছেন অভিমানী সম্রাট

faridiদু’বছর হয়ে গেল না ফেরার দেশে চলে গেছেন অভিমানি সম্রাট। তার জীবনের শেষ সময় গুলো অভিমানেই কাটিয়েছিলেন। এমনই এক বসন্তের প্রহরে সবাইকে ছেড়ে চলে চলে গিয়েছিলেন তিনি। প্রকৃতি নতুন ফুল আর পাতা দিয়ে নিজেকে অপরুপ সাজে সাজিয়ে বিদায় জানিয়েছিল এই মহান অভিনেতাকে। তার চলে যাওয়া অনেকটা স্বাভাবিক ভাবে নিয়েছিল তার অনেক কাছের মানুষগুলো। একারনেই কি আভিমানি ছিলেন তিনি?

তার মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে তার প্রিয়তমা তাকে এত স্বাভাবিক ভাবে দেখতে এসেছিল, তা জানিয়ে দেয় অভিমানী সম্রাট কতটা অভিমানি ছিলেন। তার প্রিয়তমা মেনে নিয়েছিল এই মহান অভিনেতা এভাবেই একদিন তাকে না বলেই চলে যাবে।

বাংলা নাটক ও চলচিত্রের পর্দা কাপানো শক্তিমান অভিনেতা হুমায়ূন ফরিদী ২০১২ সালের এই দিনে কোটি কোটি ভক্তকে চোখের জলে ভাসিয়ে চলে গেছেন।

নব্বুয়ের প্রথম দিকে কৌতুকচ্ছলে একজন নামকরা শৌখিন হস্ত রেখা বিশারদ তার হাত দেখতে দেখতে চিৎকার করে উঠেছিলেন “MY GOD! WHO HAS CAGED THE LION”।

কার্যত ঘটেছেও তাই। হস্ত রেখা বিশারদের ভবিষ্যতে নয় বরং আপন প্রতিভায় উদ্ভাসিত এই অভিনয় সম্রাট লাখো কোটি ভক্তের হ্রদয়ে সহজেই জায়গা করে নিয়েছিল।

সংশপ্তক নাটক প্রচারের অনেক আগে থেকেই হুমায়ুন ফরিদী মঞ্চ এবং টিভি নাটকের শীর্ষস্থানীয় অভিনেতা ছিলেন। এই নাটকটিকে তার শ্রেষ্ঠ কাজও বলা যায় না। তবুও বাংলাদেশ টেলিভিশনের সর্বকালের সবচেয়ে জনপ্রিয় চরিত্র হিসেবে বেশিরভাগ মানুষই বোধহয় ‘কান কাটা রমজান’কেই পছন্দ করবেন। ভয়ংকর কুটিল এবং ধুরন্ধর এবং একই সাথে কিছুটা কমেডি ধাচের রমজান চরিত্রটি ফরিদী যেভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন, তার কোন তুলনা হতে পারে না। ব্ল্যাক কমেডির সার্থক চিত্ররুপ বলা যেতে পারে নাটকে তার অংশটুকুকে। নাটকের অন্যসব জাঁদরেল অভিনেতা/অভিনেত্রীদের তার সামনে নিষ্প্রভ মনে হত সবাইকেই।
ছোট পর্দা থেকে শুরু করে বড় পর্দায় তিনি ছিলেন একটি কিংবদন্তি। তার মত একজন শিল্পীর অভাব পূরণ হবার নয়। বাংলাদেশের  চলচ্চিত্র যাদের অসাধারণ অভিনয়ের মধ্য দিয়ে কৃতিত্বের সাথে এগিয়ে গিয়েছিল হুমায়ূন ফরীদি তাদের মধ্যে প্রথম শ্রেণীর একজন অভিনেতা।

জন্ম ঢাকার নারিন্দায়।  বাবার নাম এটিএম নূরুল ইসলাম ও মা বেগম ফরিদা ইসলাম। চার ভাই-বোনের মধ্যে তার অবস্থান ছিল দ্বিতীয়। ইউনাইটেড ইসলামিয়া গভর্নমেন্ট হাই স্কুলে পড়াশোনা করেছেন। মাধ্যমিক স্তর উত্তীর্ণের পর চাঁদপুর সরকারী কলেজে পড়াশোনা করেন। এরপর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় স্নাতক (সম্মান) অর্থনীতি বিষয়ে পড়াশোনান্তে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী লাভ করেন। ১৯৭৬ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত নাট্য উৎসবে তিনি অন্যতম সংগঠক ছিলেন। মূলতঃ এ উৎসবের মাধ্যমেই তিনি নাট্যাঙ্গনে পরিচিত মুখ হয়ে উঠেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্থাতেই তিনি ঢাকা থিয়েটারের সদস্যপদ লাভ করেন।

এরপর তিনি গণমাধ্যমে অনেক নাটকে অভিনয় করেন। ১৯৯০-এর দশকে হুমায়ুন ফরীদি চলচ্চিত্র জগতে প্রবেশ করেন। সেখানেও তিনি বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করেন। বলা হয়ে থাকে যে, স্যুটিংস্থলে অভিনেতার তুলনায় দর্শকেরা হুমায়ুন ফরীদির দিকেই আকর্ষিত হতো বেশি। বাংলাদেশের নাট্য ও সিনেমা জগতে তিনি অসাধারণ ও অবিসংবাদিত চরিত্রে অভিনয়ের জন্য স্মরণীয় হয়ে আছেন।

ব্যক্তিগত জীবনে হুমায়ুন ফরিদী দুবার বিয়ে করেন। প্রথম বিয়ে করেন ১৯৮০’র দশকে। ‘দেবযানী’ নামের তার এক মেয়ে রয়েছে এ সংসারে। পরবর্তীতে বিখ্যাত অভিনেত্রী সুবর্ণা মোস্তফাকে তিনি বিয়ে করে দীর্ঘ সময় সংসার জীবনে আবদ্ধ থেকে তাদের মধ্যেকার বিবাহ-বিচ্ছেদ ঘটে ২০০৮ সালে।

২০০৪ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার  লাভ করেন হুমায়ুন ফরীদি। নাট্যাঙ্গনে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ৪০ বছর পূর্তি উপলক্ষে  তাকে সম্মাননা প্রদান করেন।

হুমায়ূন ফরীদি নেই ব্যাপারটি ভাবতেই ভক্তদের মনটা খারাপ হয়ে যায়। আর দেখতে পাবে না তারা কান কাটা রমজান খ্যাত সংশপ্তক নাটকের অভিনেতাকে। পালাবি কোথায়, প্রেত নাটক, মায়ের অধিকার ইত্যাদি অসংখ্য চিরন্তন কীর্তি যেগুলো চোখের সামনে ভেসে ওঠে যখন মনে হয় তিনি নেই। বাংলার প্রতিটি মানুষের  স্মৃতির মনি কোঠায় তিনি বেচে থাকবেন।তার আত্মার অপার শান্তিকামনা এবং বর্নাঢ্য অভিনয়জীবনের প্রতি রয়েছে ভক্তদের অসীম শ্রদ্ধা।

তার মত একজন শিল্পীর অভাব পূরণ হবার নয়। তার মৃত্যুতে চলচিত্রের অভিনয় পরিসীমা অনেকটা সীমিত হয়ে পরেছে কেননা তার বিকল্প অভিনেতা আমাদের চলচ্চিত্রে নেই। হুমায়ুন ফরীদির প্রতি  শ্রদ্ধা ও ভালবাসা।