

২৫শে নভেম্বর ১০ম জাতীয় সংসদ নির্বাচন তফসিল ঘোষণার পর ২৫শে ডিসেম্বর পর্যন্ত কেটে গেল ৩০ কার্যদিবস। এই ৩০ দিনে একটি হরতাল অবরোধের সময়সীমা শেষ হবার আগেই ছক আঁকা ছিল আরেকটি হরতাল অবরোধের । সাপ্তাহিক ছুটি শুক্রবার ও সরকারি ছুটি ব্যতীত সব দিনেই ছিল হরতাল কিংবা অবরোধ। এ অবস্থায় আটকা পড়েছে দেশের অর্থনীতি, স্থবির হয়ে পড়েছে বন্দর নগরী চট্টগ্রাম।
দেখা গেছে, তফসিল ঘোষণার পর ১৮ দলীয় জোটের ডাকা চারবারে মোট ২২ দিন হরতাল অবরোধ ও জামায়াতের ডাকা ১ দিন হরতালে ২৩ দিন অবরুদ্ধ ছিল দেশ। বাকি ৭ দিনের মধ্যে ৪ দিন সাপ্তাহিক ছুটি ও ৩ দিন সরকারি ছুটি। হরতাল ও অবরোধর কবলে পরে কার্যদিবস শূন্য কেটে গেল ৩০ দিন।
চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতারা জানান, হরতাল অবরোধের কারণে বেচা-কেনা প্রায় বন্ধ থাকলেও থেমে নেই ব্যাংক ঋণের বিপরীতে উচ্চহারে সুদ, কর্মচারীর বেতন, দোকান-গোডাউন ভাড়াসহ আনুষঙ্গিক খরচ। টানা ৩০ দিনে কোনো কার্যদিবস পায়নি ব্যবসায়ীরা । চলতি মাসেও কোনো কার্যদিবস পাবে কি না তাও নিশ্চিত নয়। রাজনৈতিক এমন কর্মসূচিতে চরম অসন্তোষ দেখা দিয়েছে চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীদের মাঝে।
২৫ শে নভেম্বর ১০ জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর তা প্রত্যাহারের দাবিতে ২৬ নভেম্বর মঙ্গলবার থেকে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত অবরোধের ডাক দেয় ১৮ দলীয় জোট। তারপর শুক্রবার বাদ দিয়ে শনিবার ২৯ শে নভেম্বর থেকে ৫ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার পর্যন্ত চলে দ্বিতীয় দফায় অবরোধ। তারপর শুক্রবার বাদ দিয়ে আবারও তৃতীয় বারের মতো ডাক দেয় চারদিনের অবরোধ । মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৬ টায় তা শেষ হবার কথা থাকলেও তা বাড়িয়ে ১২ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার পর্যন্ত করা হয়।
১৪ তারিখ বুদ্ধিজীবী দিবসে সরকারি ছুটি থাকায় ১৫ ডিসেম্বর রোববার যুদ্ধাপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি কাদেরমোল্লার ফাঁসির প্রতিবাদে হরতালের ডাকদেয় জামায়াত শিবির। ১৬ ডিসেম্বর সোমবার স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষ্যে সরকারি ছুটি থাকায় মঙ্গলবার থেকে আবারও ৭২ ঘণ্টা অবরোধের ডাক দেয় ১৮ দলীয় জোট। অর্থ্যাৎ গেল ৩০ দিনের মধ্যে ২৩ দিনই ছিল হরতাল কিংবা অবরোধ। ৪ দিনের সপ্তাহিক ছুটিসহ বাকি ৩ দিনই ছিল সরকারি ছুটি। তাই গেল ৩০ দিনে কোনো কার্যদিবস পায়নি ব্যবসায়ীরা। এতকিছুর পরও খুব শিগগিরই যে সব রাজনৈতিক সংকট সমাধান হয়ে যাবে তার কোনো সম্ভাবনা দেখছেন না তারা।
ব্যবসায়ী নেতারা জানান, দেশের এরূপ অবস্থায় আমদানি-রপ্তানি, উৎপাদন, সরবরাহ ও ব্যবসায়ীক কার্যক্রমে স্থবিরতা দেখা দেওয়ায় প্রতিনিয়ত বাড়ছে লোকসান। মহাসড়কে পণ্য পরিবহনে ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটায় ঠিক সময়ে পণ্য যেমন বন্দরে পৌঁছানো যাচ্ছে না তেমনি আনাও যাচ্ছে না আমদানি করা পণ্য। তাই দিনে দিনে বেড়েই চলেছে ক্ষতির খাতার তালিকা। দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার কোন ধরনের লক্ষন না দেখায় নতুন করে কেউ বিনিয়োগ করছেন না। তাই পুঁজির স্বল্পকায় অনেক ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান প্রায় বন্ধ হয়ে যাবার পথে বলে জানিয়েছেন তারা।
শতবর্ষী বাণিজ্য সংগঠন চিটাগং চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি মাহবুবুল আলম অর্থসূচককে বলেন, গেল প্রায় একমাস ধরে হরতাল অবরোধ থাকায় অধিকাংশ সময় বন্ধ ছিল ব্যবসায়ীক কর্মকাণ্ড। শুধু চেম্বার ব্যবসায়ীদের ক্ষতি হয়েছে চব্বিশ হাজার কোটি টাকার মতো। তাই হরতালের কারণে আমদানি রপ্তানি বন্ধ থাকলেও ব্যাংক সুদ, কর্মচারীদের বেতন, গোডাউন ও অফিস ভাড়াসহ আনুষঙ্গিক খরচ বন্ধ থাকে না। সেই সঙ্গে হরতালে মহাসড়কে নাশকতার ভয়ে বন্দর থেকে পণ্য খালাস করতে না পাড়ায় অতিরিক্ত মাশুল দিতে হয়। এমতাবস্থায় ব্যবসায়ীদের একদিকে যেমন লোকসান বাড়ছে অন্য দিকে কমে যাচ্ছে পুঁজি। এই এক মাসের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে খুব শিগগিরই স্বাভাবিক পরিবেশ দরকার ।
তৈরী পোশাক শিল্পমালিকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএ’র সাবেক প্রথম সহ সভাপতি নাসির উদ্দিন অর্থসূচককে বলেন, “ গেল ৩০ দিনে কোনো কার্যদিবস না পাওয়ায় ব্যবসায়িক কার্যক্রম পুরোপুরি বন্ধ হওয়ার পথে। মহসড়কে পোশাক ও গার্মেন্ট কাঁচামাল ভর্তি ট্রাকে অগ্নি সংযোগের ঘটনায় ক্ষতির পরিমাণ বেড়েই চলেছে। বিগত ৩০ বছরে বিশ্বজুড়ে বাংলাদেশের পোশাক শিল্প যে সুনাম অর্জন করেছে তা বিগত কয়েক মাসেই ধ্বংশ হয়ে গেছে।
একদিনের হরতাল কিংবা অবরোধে চট্টগ্রামের পোষাক শিল্প ব্যবসায়ীদের দৈনিক ক্ষতি হয় ২৫০ কোটি টাকা। শতভাগ রপ্তানিমুখী পোশাক কারখানাগুলো সময়মত কাঁচামাল না পাওয়া, পোশাক কারখানা স্বাভাবিক কার্যক্রম করতে না পারায় উৎপাদন কমে গেছে ৪০ শতাংশের বেশি। এদিকে বায়ারদের নির্ধারিত সময়ে পণ্য ডেলিভারি দিতে না পারায় অর্ডার বাতিল হচ্ছে প্রতিদিন। এদিকে বায়াররা ‘নন ডেলিভারি ক্লেইম’ও করার প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে আমরা জানতে পেরেছি। গেল মাসে উৎপাদন ৪০ শতাংশ কমে যাওয়ার পাশাপাশি বেড়েছে লোকসানের পরিমান । রাজনৈতিক নেতাদের এমন কর্মকান্ডে ঘৃণা জানানোর ভাষা নেই । ”
খাতুনগঞ্জের মেসার্স মোহাম্মাদিয়া ট্রেডার্স’র স্বত্বাধিকারী ও ব্যবসায়ী নেতা মোজাম্মেল হক মিন্টু অর্থসূচককে বলেন, “খাতুনগঞ্জে চার সহস্রাধিক দোকান রয়েছে । গড়ে প্রায় নয় থেকে ১০ হাজার কোটি টাকা লেনদেন হয়। গেল ৩০ দিন কোন কার্যদিবস না পাওয়ায় বাজারের বেচাকেনা প্রায় বন্ধ থাকে। ফলে ব্যবসায় দেখা দিয়েছে স্থবিরতা । দ্রুত সমাধান না হলে দেশের অর্থনীতি মুখ থুবরে পড়বে।”
এআর