
বিদেশি ঋণের সুদহার কম থাকায় এ ঋণের দিকে ঝুঁকছে ব্যবসায়ীরা। গত কয়েক বছরে এর মাত্রা বেড়েই চলেছে। ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৬৫ টি প্রতিষ্ঠানের জন্য ১০৪ কোটি ১৮ লাখ ৩০ হাজার মার্কিন ডলার ঋণ অনুমোদন করেছে বিনিয়োগ বোর্ড। ২০১২ সালে মোট ৮১ টি প্রতিষ্ঠানের জন্য ১৫৮ কোটি ১৩ লাখ ৭০ হাজার মার্কিন ডলার ঋণ অনুমোদন করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
এসব ঋণ নেওয়া হয় বিদেশি মুদ্রায়, পরিশোধও করা হয় বিদেশি মুদ্রায়। সুতরাং এসব ঋণ বেশি হলে দেশের ওপর চাপ বেড়ে যাবে। এ কারণে এসব ঋণ সীমার মধ্যে রাখাটাই দেশের জন্য ভালো বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।
এ ব্যাপারে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা বিএম মির্জা আজিজ অর্থসূচককে বলেন, বিদেশি ঋণে সুদহার অপেক্ষাকৃত কম। যেখানে আমাদের ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে ১৫ থেকে ১৮ শতাংশ সুদ দিতে হয় সেখানে বিদেশি ঋণে এ হার ৪ থেকে ৬ শতাংশের মধ্যে থাকে। ফলে বিদেশি ঋণের দিকে ঝুঁকছে ব্যবসায়ীরা।
তবে ঋণটা কোন খাতে ব্যবহার হচ্ছে এবং ঋণের মেয়াদ কেমন তার ওপর এ ঋণের সফলতা নির্ভর করে। স্বল্প মেয়াদি ঋণ যদি দীর্ঘ মেয়াদি উৎপাদনশীল খাতে ব্যবহার করা হয় তাহলে উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্থ হবে। একইভাবে এসব ঋণ যদি আমদানি কমাতে পারে এমন খাতে ব্যবহার না করা হয় তাহলে কারেন্সি ক্ষতিগ্রস্থ হবে। তাই এ ঋণ অনুমোদনের ক্ষেত্রে সতর্ক থাকা উচিত বলে তিনি মনে করেন।
তিনি আরও বলেন, বিশ্বে ১৯৯৭-৯৮ সালে যে অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দেয় তার পিছনে মূল কারণ ছিলো এ বৈদেশিক ঋণ। আমাদের দেশে এ ঋণ এখন আতঙ্কজনক পর্যায়ে পৌঁছায়নি বলে তিনি জানান।
তবে দেশের অভ্যন্তরের ব্যাংকগুলোকে ব্যবসায়ীদের দিকে নজর দিয়ে সুদহার কমানো উচিৎ বলে তিনি মনে করেন।
উল্লেখ্য, দেশীয় উদ্যোক্তারা বিদেশি ঋণের দিকে ঝুঁকছেন ২০১১ সাল থেকে। ২০১০ সালে পুঁজিবাজারে বড় ধরনের ধস নামে। ওইসময় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর নিজস্ব বিনিয়োগ ছিল প্রায় ২৮ হাজার কোটি টাকা। পুঁজিবাজারের পতন হওয়ার পর ব্যাংকের এ টাকা আটকে যায়। এর ফলে ২০১১ সালের শুরুতেই ব্যাংকগুলো তীব্র তারল্য অর্থাৎ নগদ টাকার সংকটে পড়ে। অন্যদিকে বেশিরভাগ ব্যবসায়ীদের টাকা পুঁজিবাজারে আটকে যায়। একদিকে ব্যাংকের টাকার সংকট, অন্যদিকে ব্যবসায়ীদের চাহিদা, দুই মিলে ব্যবসায়ীরা টাকার জন্য দিশেহারা হয়ে পড়েন। এসময় মড়ার উপর খাঁড়ার ঘাঁ হিসেবে দেখা দেয় ৫টি উৎপাদনশীল খাতে ঋণের সুদ হারের সর্বোচ্চ সীমা ১২ শতাংশ প্রত্যাহার করায়। এ সুযোগে ব্যাংকগুলো ঋণের সুদের হার এক লাফে সর্বোচ্চ ২২ শতাংশ পর্যন্ত নিয়ে যায়।
এরপর থেকেই ব্যবসায়ীরা বিদেশি ঋণের দিকে ঝুকেঁ পড়ে। তথ্য অনুযায়ী ২০১১ সালে বিদেশি ঋণ নেওয়া হয়েছিল প্রায় ৮২ কোটি মার্কিন ডলার। ২০১২ সালে ৮১ টি প্রতিষ্ঠান ১৫৮ কোটি ১৩ লাখ ৭০ হাজার ডলার ঋণ নেয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিদেশি ঋণ নেয় গ্রামীণফোন। প্রতিষ্ঠানটির জন্য ঋণ অনুমোদন করা হয় ৩ কোটি ৫৫ লাখ মার্কিন ডলার। একই বছর ঋণ নেওয়া দ্বিতীয় সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান হলো সামিট মেঘনা পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটি বিদেশ থেকে ঋণ নেয় এক কোটি ৯০ লাখ মার্কিন ডলার। আর তৃতীয় অবস্থানে থাকা ওরাসকম ঋণ নিয়েছে এক কোটি ৭০ লাখ মার্কিন ডলার।
২০১৩ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৬৫ টি প্রতিষ্ঠানের জন্য ঋণ অনুমোদন করা হয়েছে ১০৪ কোটি ১৮ লাখ ৩০ হাজার ডলার। এর মধ্যে সামিট বিবিয়ানা-২ লিমিটেড কোম্পানির জন্য ২ কোটি ৪০ লাখ মার্কিন ডলার এবং এয়ারটেল কোম্পানির জন্য ২ কোটি মার্কিন ডলারের বেশি ঋণ অনুমোদন করেছে বিনিয়োগ বোর্ড। আর এসব ঋণ অনুমোদন করা হয়েছে তিনমাস লন্ডন ইন্টার ব্যাংক লেনদেনের সুদহারের (লাইবর) সাথে সাড়ে ৪ শতাংশ সুদে।
অনুমোদিত এসব ঋণের মেয়াদ সাড়ে ৪ বছর থেকে ৭ বছর।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র ম. মাহফুজুর রহমান অর্থসূচককে বলেন, দেশীয় ব্যাংকের ঋণের সুদের হার বেশি হওয়ায় বিদেশ থেকে ঋণ নিচ্ছে বিনিয়োগকারীরা। এক্ষেত্রে তারা যে দেশ থেকে বেশি সুবিধা পাচ্ছে সে দেশ থেকে ঋণ পাওয়ার জন্য আবেদন করছে। এ ঋণ আমাদের রিজার্ভের ওপর কোন প্রভাব ফেলবে না। দেশীয় শিল্প প্র্রতিষ্ঠানের বিকাশে এ ঋণ প্রয়োজন আছে। বিদেশ থেকে নেয়া এ ঋণ আমাদের ব্যাংকগুলোর ওপরও কোন প্রভাব ফেলবে না বলে তিনি জানান।