
রাজনৈতিক অস্থিরতা,সময় মত গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংযোগ না পাওয়াসহ বিভিন্ন কারণে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এসএমই) এবং বড় শিল্প খাতে ঋণ বিতরণ কমে গেছে। চলতি বছরের তৃতীয় প্রান্তিকে (জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর) এসএমই ও বড় শিল্প-উভয় খাতে ঋণ বিতরণ হয়েছে আগের বছরের চেয়ে কম। এমনকি বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকের চেয়েও তৃতীয় প্রান্তিকে কম ঋণ বিতরণ হয়েছে।
চলতি বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকের (এপ্রিল-জুন) তুলনায় তৃতীয় প্রান্তিকে শিল্প খাতে ঋণ বিতরণ কমেছে প্রায় ১৫ শতাংশ। আর আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় তা প্রায় ৮ শতাংশ কমেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
গত প্রান্তিকে এসএমই খাতে ঋণ বিতরণ করা হয়েছে ১৯ হাজার ৬২৪ কোটি টাকা। বিতরণকৃত এ ঋণ আগের প্রান্তিকের (এপ্রিল-জুন) তুলনায় ৮ দশমিক ৩২ শতাংশ কম। আর শিল্প খাতে জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মেয়াদি ঋণ বিতরণ করা হয়েছে আট হাজার ৮৮১ কোটি টাকা। বিতরণ করা এই ঋণ গত অর্থবছর (২০১২-১৩)-এর প্রথম প্রান্তিকের তুলনায় সাড়ে ৮ শতাংশ এবং শেষ প্রান্তিকের তুলনায় সাড়ে ১৫ শতাংশ কম। সম্প্রতি প্রকাশিত বাংলাদেশ ব্যাংকের জুলাই-সেপ্টেম্বর ভিত্তিক ত্রৈমাসিক প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
ঋণ কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে রাজনৈতিক অস্থিরতাকেই দায়ি করছেন অর্থনীতিবিদরা। এটা অর্থনীতির জন্য শুভকর নয় বলে মনে করেন তারা। এর ফলে অর্থনীতিতে মারাত্নক প্রভাব পড়তে পারে। কর্মসংস্থান কমে যাওয়ায় দারিদ্র্য বাড়বে। রাজনৈতিক এ পরিস্থিতি চলমান থাকলে দেশ অর্থনৈতিক ভাবে সংকটে পড়তে পারে বলে জানিয়েছেন এসব অর্থনীতিবিদরা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো এসএমই খাতে ৬২ হাজার ৪৭২ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করেছে। এর মধ্যে জুলাই-সেপ্টেম্বরে বিতরণ করা হয়েছে ১৯ হাজার ৪৯৬ কোটি টাকা। বিতরণকৃত এ ঋণের পরিমাণ আগের প্রান্তিক (এপ্রিল-জুন)-এর তুলনায় ৩ হাজার ৮৭২ কোটি টাকা কম।
আর চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো একত্রে ৩৩ হাজার ৪১ কোটি টাকার শিল্পঋণ বিতরণ করেছে,যা গত অর্থবছরের শেষ প্রান্তিক অর্থাৎ ২০১৩ সালের এপ্রিল-জুন মাসে বিতরণকৃত ঋণের চেয়ে ৯ দশমিক ৬৭ শতাংশ কম। গত অর্থবছরের শেষ প্রান্তিকে বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান মিলে শিল্প ঋণ বিতরণ করেছিল ৩৬ হাজার ৫৮০ কোটি টাকার মত।
এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা বি এম মির্জা আজিজ অর্থসূচককে বলেন, দীর্ঘ দিন ধরে রাজনীতিতে একটা অস্থিতিশীল পরিস্থিতি বিরাজ করেছ তাই শিল্প ও এসএমই খাতে ঋণ কমে যাওয়া অপ্রত্যাশিত নয়। তবে এমন রাজনৈতিক পরিস্থিতি দীর্ঘদিন চলতে থাকলে আমাদের অর্থনৈতিক অবকাঠামো ভেঙ্গে পড়বে। জাতীয় প্রবৃদ্ধি ৫ দশমিক ৭ শতাংশে নেমে আসতে পারে বলে তিনি জানান।
তিনি আরও বলেন, আমাদের প্রাইভেট সেক্টরের প্রবৃদ্ধিও অনেক কমে গেছে। ব্যবসা পরিচালনা না করতে পারায় ব্যবসায়িরা নতুন করে বিনিয়োগ করছে না। বিনিয়োগ কমলে প্রবৃদ্ধি কমে যাবে। কর্মসংস্থান কমে যাবে। ফলে দারিদ্র্য বাড়বে। আর এ ধারা চলতে থাকলে অর্থনীতিতে একটা মারাত্নক প্রভাব পড়তে পারে। অর্থনীতির এসব অনিশ্চয়তা দূর করতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা জরুরি বলে তিনি জানান।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ অর্থসূচককে বলেন, আমাদের অর্থনীতিকে গতিশীল রেখেছিল প্রাইভেট সেক্টর। ঋণ কমে যাওয়ার অর্থ হলো প্রাইভেট সেক্টরে বিনিয়োগ কমে যাওয়া। বর্তমানে দেশে বিনিয়োগের কোন পরিবেশ নেই। ফেল ঋণের চাহিদাও কমে গেছে। আমাদের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড প্রায় স্থবির হয়ে পড়েছে। এ পরিস্থিতি আমাদের গতিশীল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে ৬ শতাংশের নিচে নামিয়ে দেবে। ফলে কর্মসংস্থান কমবে। মানুষের মধ্যে হতাশা তৈরি হবে।
তিনি আরও বলেন, রাজনৈতিক এ পরিস্থিতি দীর্ঘদিন চলতে থাকলে অর্থনীতিতে মধ্যমেয়াদী একটা সংকট তৈরি হতে পারে। আশপাশের অন্যান্য দেশের চেয়ে আমাদের যে একটি ভাল প্রবৃদ্ধি ছিল সেটা ব্যহত হবে। রপ্তানি কমে গেলে সেটা আগের অবস্থানে নিয়ে আসতে কয়েক বছর লেগে যেতে পারে বলে তিনি জানান।
আমাদের দেশের জনগণ অনেক বেশি কর্মঠ। তারা যেকোনো পরিস্থিতি দ্রূত সামাল দিতে পারে। এ কারণে রাজনৈতিক পিরিস্থিতি দ্রূত শান্ত করা গেলে উন্নয়নের ধারা তাড়াতাড়িই ফিরিয়ে আনা সম্ভব বলে তিনি মনে করেন।