
কুমিল্লায় গত পাঁচ মাসে ৪ ব্যাক্তি অপহৃত হলেও এখনো খোঁজ মেলেনি কোনো ব্যক্তির। দীর্ঘদিন ধরে অপহৃত ব্যাক্তিরদের অপেক্ষায় থাকতে থাকতে অবশেষে তাদের স্বজনদের পরিবারগুলোতে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। নিজ বাসা থেকে তুলে নিয়ে যাওয়ার ৫ মাস অতিবাহিত হলেও এখনো তারা নিখোঁজ রয়েছেন বলে অভিযোগ তাদের পরিবারের।
জানা যায়, লাকসাম উপজেলা বিএনপির সভাপতি, সাবেক এমপি সাইফুল ইসলাম হিরু, লাকসাম পৌরসভার বিএনপির সভাপতি হুমায়ুন কবীর পারভেজ, কুমিল্লা যুবগীল নেতা কাজী রকিবুল হাসান শাওন এবং মহিউদ্দিন নামে এক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীকে র্যাব ও পুলিশের পোশাক পরা একটি দল বাসা থেকে তুলে নিয়ে যায়। আর এ বিষয়ে কুমিল্লা পুলিশ, বিজিবি ও র্যাবের কোনো সংস্থাই তাদের আটকের বিষয়টি স্বীকার করছে না।
বিএনপির নেতা-কর্মীরা বলছেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় চিরস্থায়ী হওয়ার জন্য বিএনপির নেতা-কর্মীদের গুম, খুন ও মিথ্যা মামলা ছাপিয়ে দিচ্ছে। তারা অন্যায়, দুর্নীতি, হত্যা, গুম ইত্যাদি কর্মকাণ্ড করে দেশে আতংক সৃষ্টি করছে।
কুমিল্লায় গুমের প্রথম ঘটনাটি ঘটে ২০১৩ সালের ২৭ নভেম্বর। লাকসাম উপজেলা বিএনপির সভাপতি, সাবেক এমপি সাইফুল ইসলাম হিরু, পৌর বিএনপি সভাপতি হুমায়ুন কবির ও জসিম উদ্দিন মিলে দলের আহত নেতা-কর্মীদের খোঁজখবর নিতে অ্যাম্বুলেন্সে করে কুমিল্লা হাসপাতালে যাচ্ছিলেন। এ সময় পথে আলীশ্বর এলাকায় রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়ে অ্যাম্বুলেন্সটি থামিয়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নেওয়া হয় তাদের।
পরে অ্যাম্বুলেন্স চালক সাদেক তার গাড়ি নিয়ে লাকসাম ফিরে যায়। তার বর্ণনা মতে, ঐ তিন নেতাকে যারা নিয়ে যায় তারা ছিল র্যাবের একটি দল। পরে সদর দক্ষিণের পদুয়ার বাজার বিশ্বরোড এসে সাইফুল ইসলাম হিরু ও হুমায়ুন কবীর পারভেজকে রেখে আরেকটি গাড়িতে জসিম উদ্দিনকে তুলে দিয়ে হিরু-হুমায়ুনকে বহন করা গাড়িটি চলে যায়।
রাত ১২টা থেকে ১টার মধ্যে লাকসাম থানায় জসিমসহ আরও ১০/১২ জনকে হস্তান্তর করে র্যাব-১১ ক্রাইম প্রিভেনশন কোম্পানি-২ এর ডিএডি শাহজাহান আলী। যার পরিচিতি নং ৬০৯২। বিএনপি নেতা জসিমসহ লাকসাম থেকে আটককৃত অন্যদের আদালতের মাধ্যমে জেল হাজতে প্রেরণ করা হয়।
লাকসাম পৌরসভার বিএনপি নেতা জসিম বলেন, হিরু ভাই, পারভেজ ভাই ও আমাকে র্যাব গ্রেপ্তার করেছিল। পরে বিশ্বরোড এসে গাড়ি থামিয়ে আমাকে অন্য একটি গাড়িতে তুলে বলা হয় তাকে থানায় দিয়ে দাও। পরে হিরু ভাই ও পারভেজ ভাইকে নিয়ে ঐ গাড়িটি র্যাব কোথায় যায় তা আর আমি জানি না। এই দুই রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বর্তমানে কোথায় আছেন তা তাদের পরিবার-পরিজন ও নেতাকর্মী জানেন না। বিশেষ করে এই দুই নেতার স্ত্রী, পুত্র-কণ্যাদের গত ৫ মাস কাঁটছে নির্ঘুম রাত।
অপহরণের ২য় ঘটনাটি ঘটে ২০১৪ সালের ২৯ মার্চ। সেদিন ভোরে যুবলীগ নেতা শাওন তার স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে ঘুমন্ত অবস্থায় ছিল। এ সময় র্যাবের হাতে আটক জনৈক আনোয়ারকে দিয়ে মোবাইলের মাধ্যমে শাওনের বাসায় অবস্থানের বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়। পরে র্যাব এর পরিচয়ে দুই জন গেঞ্জি ও প্যান্ট পরিহিত অস্ত্রসহ আরও ১৫/২০ জন কালো পোশাক পরিহিত ও সাদা পোশাকধারী একটি দল শাওনের বাড়ির চারদিক ঘেরাও করে। ঘরের দরজায় লাঠি দ্বারা জোরে আঘাত করতে থাকলে তার বাবা আবদুল মতিন ঘুম থেকে ওঠে দরজা খুলে পরিচয় জানতে চান। কিন্তু কালো পোশাকধারী র্যাব সদস্যরা তাকে ধাক্কা দিয়ে ঘরে প্রবেশ করে বিভিন্ন কক্ষে ব্যাপক তল্লাশি চালিয়ে শাওনকে ঘুমন্ত অবস্থায় টেনেহিঁচড়ে নিয়ে গাড়িতে তুলে।
শাওনের স্ত্রী ফারজানা তাকে নেওয়ার কারণ জানতে চাইলে তাকে হাতুরি দিয়ে মাথায় আঘাত করে এবং শাওনের বাবা-মাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। তারা শাওনকে নিয়ে একটি এক্সজিএল মাইক্রো এবং র্যাবেরই দুটি গাড়ি বিষ্ণুপুরের দিকে চলে যায়।
শাওনের বাবা আবদুল মতিন বলেন, ঘটনার পর ওইদিন সকাল ১০টায় কুমিল্লাস্থ’ র্যাব-১১ শাকতলা অফিসে গিয়ে আমার ছেলেকে ধরে নিয়ে যাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে র্যাব সদস্যরা জানায়, শাওন নামে কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। এ ঘটনায় গত ৩১ মার্চ কোতয়ালী মডেল থানায় শাওনের স্ত্রী ফারজানা আক্তার মুন্নী বাদী হয়ে একটি সাধারণ ডায়রি করেন। শাওনের সন্ধান দাবিতে র্যাব ও পুলিশের নিকট একাধিকবার গিয়েও কোনো খোঁজখবর না পেয়ে তার বাবা সাবেক সেনা কর্মকর্তা কাজী আবদুল মতিন লিখিতভাবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, আইজিপি, র্যাব-১১ হেডকোয়ার্টার, ডিজিএফআই হেড কোয়ার্টার, র্যাব-১১ হেডকোয়ার্টার, কুমিল্লা পুলিশ সুপার ও পরিদর্শক ডিএসবি (ওয়াচ) এর কাছে অভিযোগ করেন।
অপহৃত শাওনের স্ত্রী ফারজানা আক্তার মুন্নী কান্নাজড়িত কণ্ঠে জানায়, ‘আমার স্বামী অপহরণের পর থেকে আমাদের একমাত্র মেয়ে রাইসা তার বাবার পথ চেয়ে বসে আছে। অপহৃত শাওনের বড় ভাই ফারুক আহমেদ খান বলেন, শাওনের অপহরণের বিষয়ে বিভিন্ন দফতরে অভিযোগ দেয়া হয়েছে। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তদন্তের নামে আমাদের সান্তনা দিয়ে গেলেও তারা সঠিক সন্ধান দিতে পারছে না । তবে এ বিষয়ে র্যাব-১১ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক জানান, ‘শাওনের পরিবারের পক্ষ থেকে র্যাব-১১কে জড়িয়ে যে অভিযোগ করা হয়েছে তার সঙ্গে র্যাব-১১ এর কোন সম্পৃক্ততা নেই।
অপরণের ৩য় ঘটনাটি ঘটে ২০১৪ সালে ২৮ এপ্রিল। কুমিল্লায় মহিউদ্দিন নামে এক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীকে র্যাব ও পুলিশের পোশাক পরা একটি দল বাসা থেকে তুলে নিয়ে যাওয়ার পর থেকে নিখোঁজ রয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন তার পরিবারের সদস্যরা। গত ২৮ এপ্রিল সোমবার দিবাগত রাত ৩টায় মহিউদ্দিনকে বাসা থেকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। পরিবারের সদস্যরা ২৯ এপ্রিল মঙ্গলবার সারাদিন কোতয়ালী থানা, ডিবি অফিস ও র্যাবের কার্যালয়ে যোগাযোগ করেও তার কোনো খবর পাননি।
পরিবারের সদস্যরা জানান, মহিউদ্দিন স্ত্রী, দুই মেয়ে এবং এক ছেলে নিয়ে শহরের মুন্সেফবাড়ি রোডে ভাড়ায় থাকতেন। সোমবার দিবাগত রাত ৩টার দিকে ২ জন র্যাবের পোশাকে এবং ৩ জন পুলিশের পোশাকে এবং ৫ জন সাদা পোশাকের লোক এসে বাসায় তার নাম ধরে ডাকাডাকি করে তাকে ঘুম থেকে তুলে তাদের সাথে যেতে বলে। কিন্তু কি কারণে বা কি অপরাধে জানতে চাইলে র্যাব ও পুলিশের পোশাক পরা লোকজন মহিউদ্দিনকে মারধর করে। পরে তাকে সেখান থেকে তুলে নিয়ে যায়।
মহিউদ্দিনের স্ত্রী রীনা বেগম জানান, আমরা চিৎকার দিতে চাইলে তারা আমাদেরকে মারধরের হুমকি দেয়। আমাকে ও আমার মেয়েদের একটি রুমে ঢুকিয়ে বসিয়ে রাখে। পরে আমার স্বামীকে একটি কালো রংয়ের পুলিশের ভ্যানের মতো একটি ভ্যানে তুলে নিয়ে যায়।
এ ব্যাপারে মহিউদ্দিনের পরিবারের সদস্যরা কোতয়ালী, সদর দক্ষিণ থানা ও বিভিন্ন পুলিশ ফাঁড়িতে রাত ৯টা পর্যন্ত খোঁজাখুঁজি করেও তার কোনো সন্ধান পাননি।
আরএম/এ এস