পাঁচ কারণে অস্থির পুঁজিবাজার

বিয়ার মার্কেট, পুঁজিবাজার, Bear Market

বিয়ার মার্কেট, পুঁজিবাজার, Bear Marketগত ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসের নাটকীয় উত্থানের পর ফের টানা দর পতন শুরু হয়েছে পুঁজিবাজারে। জানুয়ারি মাসের শেষভাগ থেকে চলছে এ পতন। সময় গড়ার সঙ্গে সঙ্গে পতনের তীব্রতাও বাড়ছে। এতে অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়েছে বাজারে। বিনিয়োগকারীদের একটি বড় অংশ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। হন্যে হয়ে বাজারের এ অবস্থার কারণ খুঁজছেন তারা।

বাজারের সাম্প্রতিক অস্থিরতার পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। এর মধ্যে রয়েছে-পুঁজিবাজারে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিনিয়োগের নতুন সীমা বেঁধে দেওয়া, সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোকে অতিরিক্ত বিনিয়োগ কমিয়ে সীমার মধ্যে নিয়ে আসার পরিকল্পনা জমা দেওয়ার নির্দেশ, ব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠানের শেয়ার কেনা-বেচার বিস্তারিত তথ্য দৈনিক ভিত্তিতে জমা দেওয়ার নির্দেশ ও আইএমএফ জুজুর ভীতি। এছাড়া ডিমিউচুয়ালাইজেশনের (স্টক এক্সচেঞ্জের মালিকানা থেকে ব্যবস্থাপনাকে আলাদা করা) স্বপ্ন ভঙ্গ এবং বিনিয়োগকারীদের মনস্তত্ত্ব।

উল্লেখ, নতুন ব্যাংক কোম্পানি আইনের আলোকে গত বছরের শেষভাগে বাংলাদেশ ব্যাংক নতুন করে পুঁজিবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগসীমা বেঁধে দেয়। পাশাপাশি বলা হয়, যেসব ব্যাংকের সীমাতিরিক্ত বিনিয়োগ রয়েছে তা ২০১৬ সালের ৩০ জুনের মধ্যে সমন্বয় করতে হবে। এ সার্কুলারের রেশ কাটতে না কাটতেই নতুন আরেকটি সার্কুলার জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক।

নতুন সার্কুলারে পুঁজিবাজারে ব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান বা সাবসিডিয়ারি কোম্পানির (মূলত ব্রোকারহাউজ ও মার্চেন্ট ব্যাংক) বিনিয়োগ সীমা বেঁধে দেওয়া হয়। এদের ক্ষেত্রেও ২০১৬ সালের ৩০ জুনের মধ্যে বিনিয়োগের পরিমাণ নির্ধারিত সীমা নামিয়ে আনতে বলা হয়।

এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি ব্যাংকের সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রতিদিন শেয়ার কেনার পরিমাণ, কি শেয়ার, কোন দরে কেনা হচ্ছে এসব তথ্য জানাতে বলে। এ তিনটি কারণে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের মধ্যেও উদ্বেগ দেখা দেয়।

সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালককে তাদের বাড়তি বিনিয়োগ কিভাবে প্রত্যাহার করে নির্ধারিত সীমায় নামিয়ে আনা হবে সে পরিকল্পনা জানাতে বলে। এ চিঠির পর থেকে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো নতুন করে কোনো বিনিয়োগ করছে না, বরং প্রায় প্রতিদিনই শেয়ার বিক্রি করে বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে নিচ্ছে।

মঙ্গলবার বাংলাদেশ ব্যাংক বিদেশী পোর্টফোলিও বিনিয়োকারীদের প্রতিদিনের শেয়ার কেনার রিপোর্টিং বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গ বৈঠক করে। বিষয়টি এখন পর্যন্ত চূড়ান্ত না হলেও আতঙ্ক যা ছড়ানোর, তা ঠিক ছড়িয়েছে।

আইএমএফের প্রতিনিধি দলের বাংলাদেশ সফরকে কেন্দ্র করেও বিনিয়োগকারীদের মধ্যে ভীতি বরাজ করছে। আজ বুধবার প্রতিনিধি দলটি ঢাকা এসেছে, থাকবে ২৬ মার্চ পর্যন্ত। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক পুঁজিবাজারের স্বার্থের সঙ্গে সাংঘর্ষিক যেসব সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তার সবই আইএমএফের পরামর্শে নেওয়া হয়েছে বলে বিশ্বাস বিনিয়োগকারীদের। প্রতিনিধি দল ঢাকায় অবস্থানকালে নতুন করে কোনো ‘পরামর্শ’ দেয় কি-না তা নিয়ে উদ্বেগের শেষ নেই বিনিয়োগকারীদের।

ডিমিউচুয়ালাইজেশন নিয়েও অযৌক্তিক স্বপ্ন দেখেছিলেন অনেক বিনিয়োগকারী। খোদ অর্থমন্ত্রী এ স্বপ্নের বীজ বপন করেছিলেন। ২০১০ সালের ধসের পর তিনি একাধিকবার বলেছেন, বাজার ঠিক করার ‘ওষুধ’ পেয়ে গেছেন তিনি। আর সেটি হচ্ছে-ডিমিউচুয়ালাইজেশন। কিন্তু ডিমিউচুয়ালাইজন পরবর্তী স্টক এক্সচেঞ্জের পর্ষদ সদস্যদের দেখে স্বপ্নভঙ্গ শুরু হয়। ডিমিউচুয়ালাইজেশন হয়ে যাওয়ার পরও বাজারে দৃশ্যমান কোনো পরিবর্তন না আসায় একে নিয়ে সৃষ্ট আশাবাদ হতাশায় পরিণত হয়।

এছাড়া টানা দুই মাসের উত্থানের পর বাজারে শুরু হওয়া মূল্য সংশোধন ধারাও সাম্প্রতিক অস্থিরতার পেছনে ভূমিকা রাখছে। আমাদের বাজারে সাধারণ শেয়ারের দাম ও সূচক বাড়তে থাকলে বেশিরভাগ বিনিয়োগকারী শেয়ার কেনায় সক্রিয় হয়। বাজারে লেনদেন বেড়ে যায়। অন্যদিকে দাম কমতে থাকলে বিনিয়োগকারীরা সাইডলাইনে সরে যায়। বাজার আবার কখন উর্ধমুখী হবে সে সময়ের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। এ সময়ে তারা নতুন বিনিয়োগ করে না। বরং টানা কয়েকদিন দর পতন হলে ভয়ে আগে কেনা শেয়ার লোকসান দিয়ে হলেও বেচে দেয়। এখনও তা-ই হয়েছে। অনেক বিনিয়োগকারী শেয়ার বিক্রি করে সাইডলাইনে চলে যাচ্ছেন। এতে পতন তীব্রতর হচ্ছে।

বাজার বিশ্লষণে দেখা যায়, আলোচ্য বছরের জানুয়ারির ১ তারিখে ডিএসইএক্স সূচক ছিল ৪ হাজার ২৮৬ পয়েন্ট। এর পর প্রতিদিনই সূচক ও লেনদেন বাড়তে থাকে। মাঝে মাঝে বাজারে মূল্য সংশোধনও হচ্ছিল। এই তিন মাসের মধ্যে ফেব্রয়ারির ৬ তারিখে সূচকটি ৪ হাজার ৮৪৫ পয়েন্টে দাঁড়ায়। তারপর সূচকের উথান-পতনের মধ্যে দিয়ে চললেও, গত ১২ মার্চ থেকে বাজারে টানা দর পতন হচ্ছে। বাজারের এই ধারাবাহিক পতনে বিনিয়োগকারীদের আতঙ্ক বাড়ছে। বুধবার দিনের মাঝভাগে পতন তীব্রতর হয়ে উঠে। এ সময় লেনদেনে আংশ নেওয়া ৮২ ভাগ কোম্পানির শেয়ার দর হারায়। তবে শেষভাগে এসে কিছুটা পুনরুদ্ধার হয় তা। এদিন লেনদেনের পর সূচকটির অবস্থান দাঁড়ায় ৪ হাজার ৫১৯ পয়েন্টে।