
জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সংঘটিত সহিংসতা আঁচড় কেটে গেছে দেশের বেসরকারি খাতে। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে গত ডিসেম্বরে প্রাইভেট সেক্টরে ঋণ প্রবাহের প্রবৃদ্ধি ছিল মাত্র ১০ দশমিক ৬ শতাংশ। যা গত সাড়ে চৌদ্দ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক প্রকাশিত এক বিবরণীতে এই তথ্য জানানো হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক জানায়, ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহের পরিমাণ ছিল ৪ লাখ ৭৮ হাজার ৭৬৬ কোটি ৫০ লাখ টাকা। যা পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় মাত্র ১০ দশমিক ৬ শতাংশ বেশি। ২০১২ সালের ডিসেম্বরে এই খাতে ঋণের প্রবাহ ছিল ৪ লাখ ৩২ হাজার ৮৯২ কোটি ৪০ লাখ টাকা। অথচ, এক বছর আগেও ঋণ প্রবাহের প্রবৃদ্ধি ছিল ১৬ দশমিক ৬১ শতাংশ। ২০১১ সালের ডিসেম্বরে এই খাতে ঋণ প্রবাহ ছিল ৩ লাখ ৭১ হাজার ২৪৩ কোটি ৩০ লাখ টাকা।
বিশেষজ্ঞদের মতে, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা পুরো নভেম্বর এবং ডিসেম্বর মাস জুড়ে দেশের অর্থনৈতিক কার্যক্রমে স্থবিরতা নিয়ে এসেছিল। যার ফলে ব্যবসায়ীরা নতুনভাবে বিনিয়োগ করা থেকে বিরত ছিলেন। এমনকি অনেক ব্যবসায়ী তাদের প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। যার প্রভাবটাই দেশের আর্থিক সেক্টরের মাধ্যমে পরিলক্ষিত হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নথি অনুযায়ী, ঋণ প্রবাহের এই প্রবৃদ্ধি গত চৌদ্দ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। এর আগে এই খাতে ঋণ প্রবাহের সর্বনিম্ন প্রবৃদ্ধি ছিল ১০ দশমিক ৭৫ শতাংশ, যা ২০০০ অর্থবছরে অর্জিত হয়েছিল। অবশ্য এর পূর্বের কোন উপাত্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে সংরক্ষিত নেই।
তবে প্রবৃদ্ধির এই নিম্ন হারের পেছনে সরকারি নীতির সামঞ্জস্যহীনতাকে দায়ী করছেন অর্থনীতিবিদ সালেহ উদ্দিন আহমেদ। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক এই গভর্ণরে মতে বিনিয়োগ বাড়াতে সরকারি নীতিকে ব্যবসায় বান্ধব করা গেলে এমনটি ঘটত না।
তিনি বলেন, সরকারি নীতির ব্যর্থতার কারণের ঋণ প্রবাহের এই নিম্ন প্রবৃদ্ধি। এছাড়া বিদ্যমান পরিকাঠামোও এই নিম্ন প্রবৃদ্ধির পেছনে রসদ যুগিয়েছে, যা ব্যবসায় খাতকে পেছন থেকে টেনে ধরে রেখেছে। আর রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতাতো আছেই। সব মিলিয়ে ব্যবসায়িরা চরম দুরবস্থার মধ্যে দিনাতিপাত করছেন।
সালেহ উদ্দিনের এই অভিযোগ প্রচ্ছন্নভাবে স্বীকার করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা। তিনি জানান, ডিসেম্বরে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহে ১৫ দশমিক ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুদ্রানীতি বিনিয়োগের গতিশীলতা ধরে রাখতে পারেনি। এর ফলেই হয়তো বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবাহ আশানুরুপ হয়নি।
বাংলাদেশ ব্যাংক আরও জানায়, বেসরকারি খাতের পাশাপাশি সামগ্রিক দেশীয় ঋণ প্রবাহের প্রবৃদ্ধিও কমেছে উল্লেখযোগ্য হারে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানায়, ডিসেম্বরে দেশীয় ঋণের প্রবাহ ছিল ৬ লাখ ৫ হাজার ৯৬৯ কোটি টাকা, যা পূর্ববর্তী বছরের ডিসেম্বরের তুলনায় ১০ দশমিক ৮ শতাংশ বেশি। ২০১২ সালের ডিসেম্বরে সামগ্রিক দেশীয় ঋণ প্রবাহ ছিল ৫ লাখ ৪৬ হাজার ৯০২ কোটি। ওই সময়ে ঋণ প্রবাহে প্রবৃদ্ধি ছিল ১৪ দশমিক ৩ শতাংশ।
এ সম্পর্কে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তা জানান, রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে সরকারি উন্নয়ন কার্যক্রমও এগিয়েছে শ্লথ গতিতে। যার ফলে ব্যাংক থেকে ধারের পরিমাণও কমিয়ে দিয়েছে সরকার।
আশার কথা হল, চলতি মাসের শুরু থেকেই রাজনীতিতে আগের তুলনায় অনেক বেশি স্থিতিশীলতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। হরতাল-অবরোধের মত সহিংস কর্মসূচি থেকে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো সরে আসায় দেশের অর্থনীতি আবার স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। এছাড়াও বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন মুদ্রানীতি আশার আলো দেখাচ্ছে অর্থনীতি বিশেষজ্ঞদের।