
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে বেশ কিছুদিন ধরেই দেশে চলছে চরম অরাজকতা। হরতাল-অবরোধের নামে জ্বালাও-পোড়াও, হামলাসহ ব্যাপক নাশকতা চলছে। রোববার নির্বাচনের ভোট গ্রহণ শেষ হয়ে গেলেও এ সহিংসতা সহসাই শেষ হচ্ছে না বলে মনে করছেন দেশি-বিদেশি বিশ্লেষকরা। বরং এ নির্বাচন সহিংসতার আগুনে আরও ঘি ঢেলেছে বলেই মনে করেন তারা। আর এ আশংকার কথা উঠে এসেছে এএফপি, এপি, ওয়াশিংটন পোষ্ট ও ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের মত প্রভাবশালী সংবাদপত্রে।
উল্লেখ, নির্বাচনকেন্দ্রীক সহিংসতায় রোববার ভোট গ্রহণের দিনে ২১ ব্যক্তির প্রাণহানি হয়েছে। বিরোধী জোটের ছত্রছায়ায় সন্ত্রাসীরা একজন প্রিজাইডিং অফিসার ও একজন আনসার সদস্যকে পিটিয়ে মেরেছে। একজন প্রিজাইডিং অফিসারের হাত কেটে নিয়েছে। এক ডজনের বেশি ভোটকেন্দ্র জ্বালিয়ে দিয়েছে, যার বড় অংশই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। নির্বাচন ঠেকানোর নামে এ নাশকতা চালানো হয়েছে। তাই অনেকে আশা করছিলেন, ভোট গ্রহণের পর পরিস্থিতি শান্ত হয়ে আসতে পারে। কিন্তু কার্যত তেমনটি হওয়ার সম্ভাবনা কম বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
বিশ্লেষকদের মতে, কয়েকটি কারণে পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে পারে। প্রথমত: ব্যাপক রক্তপাতের মধ্যেও নির্বাচন শেষ করে ফেলতে পারায় জাতীয় সংসদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগিরষ্টতা নিশ্চিত হয়ে গেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগের। ফলে দলটি এখন বিরোধী জোটকে কঠোরভাবে দমন করে পুরো মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার চেষ্টা করতে পারে। সরকারের অত্যুৎসাহী কিছু নেতা ইতিমধ্যে এর কিছু আভাসও দিয়েছেন। যা বিরোধী শিবিরকে বেশ কিছুটা তাতিয়ে তুলেছে।
চলমান আন্দোলন ও চাপে সরকারকে এখনই সমঝোতায় বাধ্য করা না গেলে আগামি পাঁচ বছরের মধ্যে আর পারা যাবে না বলে বিশ্বাস করেন বিরোধী শিবিরের অনেক নেতা। তারা মনে করেন নিজেদের অস্তিত্বের স্বার্থেই চূড়ান্ত চাপ তৈরি করতে হবে সরকারের উপর।
১৮ দলীয় জোটের অন্যতম প্রভাবশালী দল জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ সবসময় বিএনপি তথা জোটকে কঠোর আন্দোলনের ঠেলে রাখবে। দলটির বেশ কয়েকজন নেতার বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের বিচার চলছে। ইতোমধ্যে সহকারী মহাসচিব আবদুল কাদের মোল্লাকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছে। আরও কয়েক জনকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে আদালত। সরকার নতুন মেয়াদের পুরোটা পার করতে পারলে এদের মৃত্যুদণ্ড ঠেকানো যাবে না। তাই শুরু থেকেই এ দলটি ১৮ দলীয় জোটকে কঠোর পথে যেতে উস্কানি দিয়ে যাচ্ছে। আর মাঠে কার্যত এরাই সক্রিয়।
প্রধান বিরোধী দল নানাভাবে চেষ্টা করেও তার নেতা-কর্মীদেরকে আন্দোলনের মাঠে নামাতে পারছে না। ফলে আন্দোলনের ক্ষেত্রে তাদেরকে জামায়াত ও তার অঙ্গ সংগঠন শিবিরের উপর অতিমাত্রায় নির্ভর করতে হচ্ছে। আর এ সুযোগকে ১৬ আনা কাজে লাগাচ্ছে দলটি। সাম্প্রতিক সময়ে দেশের বিভিন্ন এলাকায় যত ককটেল হামলা, পেট্রোল বোমা নিক্ষেপ, আইন-শৃঙ্খলারক্ষা বাহিনীর উপর আঘাত, ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ হয়েছে তার ৮০ ভাগের বেশি ঘটিয়েছে একা ছাত্র শিবির। তারা এসব কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সরকারের পতন ঘটাতে না পারলেও তাদেরকে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করবে যাতে সরকার যুদ্ধাপরাধ ইস্যুতে তেমন মনোযোগ দিতে না পারে।
রোববার ভোট গ্রহণের দিনসহ গত এক সপ্তাহের নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডের সাফল্য বিরোধী জোট তথা শিবিরকে যথেষ্ট উজ্জ্বীবিত করেছে। তাদের হামলার মুখে নির্বাচন কমিশন একশ’র বেশি কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ স্থগিত রাখতে বাধ্য হয়েছে। অন্যদিকে আগের কয়েকদিন সন্ত্রাসী শো-ডাউনে জনমনে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ায় রোববার ভোটকেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি ছিল একেবারে নগন্য। এটাকে বিরোধী জোট বড় সাফল্য বলে মনে করছে।
নির্বাচনে নগন্য সংখ্যক ভোটারের উপস্থিতি, কারচুপি, অব্যবস্থাপনা, সরকারি দলের অনিয়মে বিরোধী জোটের সাহস অনেক বেড়ে গেছে। তারা মনে করছে, গণমাধ্যমে এসব বিষয় প্রকাশ হয়ে যাওয়ায় সরকারি দলের নৈতিক শক্তি কিছুটা হলেও কমে যাবে। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ভাবমূর্তি সঙ্কট বাড়বে। তাই সরকারকে কাবু করার এটাই মোক্ষম সময়।
গত বছরের গোড়া থেকেই প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ও তার নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবিতে অআন্দোলন করে আসছে। সরকার উচ্চ আদালতের এক নির্দেশনার অজুহাতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করায় এ আন্দোলন শুরু হয়। নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে এ আন্দোলনের তীব্রতা বাড়তে থাকে।