জনশক্তি রপ্তানি ৩৪ শতাংশ কমেছে,কমবে রেমিট্যান্স

US_Italy_Saudi_MYমহাজোট সরকারের শেষ সময়ে এসে ২০১৩ সালে জনশক্তি রপ্তানিতে ধস নেমেছে। আলোচ্য বছরে ২০১২ সালের চেয়ে ৩৩ দশমিক ৫৭ শতাংশ কম শ্রমিক দেশের বাইরে যেতে পেরেছেন। বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এর জন্য বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দাকে দায়ী করলেও এ খাতের ব্যবসায়ীরা তা মানতে রাজী নন। তারা মনে করেন, দেশের দূর্বল কূটনীতির কারণে বাজার হাতছাড়া হচ্ছে। এর প্রভাবে চলতি বছর রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যেতে পারে।

বাংলাদেশ জনশক্তি রপ্তানি ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) সূত্র মতে সরকারি, বেসরকারি ও ব্যক্তি উদ্যোগে ২০১২ সালে ৬ লাখ ৭ হাজার ৭৯৮ জন কাজের উদ্দেশ্য দেশের বাইরে যান। গত বছর তা ২ লাখ ৩ হাজার ৭৮৫ জন কমে  ৪ লাখ ৩ হাজার ৮১৩ জনে নেমে আসে।

আলোচ্য বছরে জনশক্তি রপ্তানি সবচেয়ে কমেছে সংযুক্ত আরব আমিরাতে। এদেশে এ বছর মাত্র ১৩ হাজার ৯৯৩ জন জনশক্তি রপ্তানি করার সুযোগ হয়েছে। সেখানে ২০১২ সালে দেশটিতে বাংলাদেশ থেকে কর্মী পাঠানো হয়েছিল ২ লাখ ১৫ হাজার ৪৫২ জন। এ ছাড়াও ২০১২ সালের তুলনায় ২০১৩ সালে জনশক্তি রপ্তানি কমেছে সৌদি আরব, ওমানসহ আরও কয়েকটি দেশে। তবে মালয়েশিয়া, হংকং, সিঙ্গাপুরসহ কয়েকটি দেশে ২০১৩ সালে নতুন শ্রমবাজার উন্মুক্ত হয়েছে  বাংলাদেশের জন্য।

বিএমইটির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১২ সালে বিভিন্ন দেশে যাওয়া ৬ লাখ ৭ হাজার ৭৯৮ জন শ্রমিকের মধ্যে শুধুমাত্র সংযুক্ত আরব আমিরাতেই গেছেন ২ লাখ ১৫ হাজার ৪৫২ জন। এ ছাড়া ওমানে ১ লাখ ৭০ হাজার ৩২৬, সৌদি আরবে ২১ হাজার ২১২, কাতারে ২৮ হাজার ৮০১, বাহরাইনে ২১ হাজার ৭৭৭, লেবাননে ১৪ হাজার ৮৬৪, জর্ডানে ১১ হাজার ৭২৬, লিবিয়ায় ১৪ হাজার ৯৭৫, সিঙ্গাপুরে ৫৮ হাজার ৬৫৭ ও ইতালিতে ৯ হাজার ২৮০ জন গেছেন।

অন্যদিকে ২০১৩ সালে ৪ লাখ ৩ হাজার ৮১৩ কর্মী বিদেশে গেছেন। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি জনশক্তি রপ্তানি হয়েছে ওমানে। সেখানে ১ লাখ ৩২ হাজার ১৩১ কর্মী পাঠানো সম্ভব হয়েছে। এ ছাড়া সৌদি আরবে ১২ হাজার ৬৪০ জন, সংযুক্ত আরব আমিরাতে ১৪ হাজার ৯৩, কাতারে ৫৬ হাজার ৮১৯, বাহরাইনে ২৪ হাজার ৯০৯, লেবাননে ১৪ হাজার ৮৭৯, জর্ডানে ২১ হাজার ৯৯, লিবিয়ায় ৭ হাজার ১৭৫, সিঙ্গাপুরে ৫৯ হাজার ৫১২ কর্মী গেছেন। দীর্ঘদিন পর মালয়েশিয়ার  শ্রমবাজার উন্মুক্ত হলেও ২০১৩ সালে লোক গেছে মাত্র ৩ হাজার ৬৩৫ জন। এরমধ্যে সরকারি ব্যবস্থাপনায় ১ হাজার ১৪৯ জন।

জনশক্তি রপ্তানি কমে যাওয়ার বিষয়টিকে সরকার বা মন্ত্রণালয়ের ব্যর্থতা হিসেবে দেখছেন না প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন। এর জন্য তিনি বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দাকে দায়ী করেন। তিনি বলেন, ‘বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার কারণে আমরা আশঙ্কায় ছিলাম বিদেশ থেকে জনশক্তি ফিরে আসবে। কিন্তু তা হয়নি। তবে ২০১৪ সালে চার লক্ষাধিক মানুষ বিদেশে পাঠানো সম্ভব হবে বলে মনে করছি’।

বর্তমান সরকারের আমলে নতুন নতুন বাজার সৃষ্টি হয়েছে বলে দাবি করে তিনি। এ বিষয়ে মন্ত্রী বলেন,‘বিএনপি জোটের সময় ৯৭টি দেশে জনশক্তি রপ্তানি হতো। এখন ১৫৭টি দেশে বাংলাদেশি কর্মী যাচ্ছেন। আমরা নতুন করে ৬০টি দেশে জনশক্তি রপ্তানির বাজার তৈরি করেছি। ভবিষ্যতে অর্থনৈতিক মন্দা কাটিয়ে উঠলে ব্যাপক হারে বিদেশে লোক পাঠাতে সক্ষম হব।’

প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. জাফর আহমেদ জনশক্তি রপ্তানি কমে যাওয়ার বিষয় স্বীকার করলেও এর পেছনে কোনো দুর্বলতা ছিলো বলে স্বীকার করেন না। তিনি বলেন,সংযুক্ত আরব আমিরাতে জনশক্তি রপ্তানি কমে যাওয়ায় এ সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। দ্বিতীয় বৃহৎ শ্রম বাজারের দেশটিতে বিগত ২০১২ সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকেই বাংলাদেশি কর্মী নেওয়া বন্ধ রয়েছে। আমরা দেশটির সাথে বেশ কয়েকবার যোগাযোগ করেছি। আশা করছি শিগগীরই দেশটিতে পূনরায় শ্রমিক রপ্তানি শুরু হবে।

জনশক্তি রপ্তানির সাথে জড়িত সংগঠনগুলো ও অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, কূটনৈতিক ব্যর্থতা, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের অদক্ষতা ও জনশক্তি রফতানিকারক কিছু প্রতিষ্ঠানের প্রতারণার কারণে জনশক্তি রপ্তানিতে এ বিপর্যয় নেমে এসেছে।

এ বিষয়ে জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সংগঠন বায়রার উপদেষ্টা হায়দার আলী বলেন, ‘সরকার শুধু মালয়েশিয়ায় নিয়ে ব্যস্ত ছিলো।অন্য দেশগুলোতে জনশক্তি পাঠানোর উদ্যোগ নেয়নি। আর মালয়শিয়াতেও নামমাত্র কিছু জনশক্তি পাঠিয়ে লোক দেখা্চ্ছে। সরকারের কুটনৈতিক ব্যর্থতাই জনশক্তি রপ্তানিতে ধস নামার কারণ। এছাড়া মন্ত্রণালয় ও বায়রার মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হওয়াও অনেকাংশে দায়ী’।

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি)সম্মানীয় ফেলো ড.দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন,বাংলাদেশের অর্থনীতিকে চাঙা করার অন্যতম প্রধান মাধ্যম প্রবাসী-আয় (রেমিট্যান্স)। কিন্তু এ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে রেমিট্যান্স এসেছে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ৯ শতাংশ কম। আর এখন যেভাবে জনশক্তি রপ্তানি কমছে তাতে ভবিষ্যতে এ রেমিটেন্সের পরিমাণ আরও কমতে থাকবে।

তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে অর্থনীতির চাকা স্থবির হয়ে আছে। বিদেশি সাহায্যও অনেক কমে গেছে। আর এই মুর্হূতে জনশক্তি রপ্তানি কমে আসলে ২০১৪ সালের মধ্যে বাংলাদেশ মধ্যমেয়াদি অর্থনৈতিক সংকটে পড়বে।