
বছরটি শুরু হয়েছিল রাজনৈতিক অস্থিরতার আশঙ্খা নিয়ে। তবে আশা ছিল অর্থনৈতিক ভাবে দেশে এগিয়ে চলাটা আরও অব্যাহত থাকবে। বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাতের অগ্রগতি এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখবে। কিন্তু মোহাম্মদপুরের স্মার্ট ফ্যাশনে আগুন,সাভারের রানা প্লাজা ধস, স্টান্ডার্ডের কারখানায় আগুন আর ওইসব ঘটনার প্রতিক্রয়ায় এই বেশকিছু ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের মুখ ফিরিয়ে নেয়। বেতন বাড়ানোর দাবিতে চলা শ্রমিক আন্দোলন, তারপর হরতাল-অবরোধে হাজার কোটি ডলারের অর্ডার বাতিল হয়ে যাওয়া, আয় না হওয়ার অজুহাতে বেশ কিছু কারখানার উৎপাদন বন্ধ করে দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটেছে। সব কিছু মিলিয়ে এ বছরটি পোশাক খাতের জন্য খুব একটা সুবিধার কাটেনি।
মোহাম্মদপুরের স্মার্ট ফ্যাশনে ৭ জন, রানা প্লাজা ধসে হাজারো মানুষের প্রাণহানি কাঁদিয়েছে বিশ্ব মানবতাকে। এখনও রানা প্লাজার ধ্বংসস্তুপ থেকে বেড়িয়ে আসছে মানুষের হার, মাথার খুলি। এনাম মেডিকেল ও অধরচন্দ্র বিদ্যালয়ে পরিচয়পত্র হাতে নিয়ে সন্তানের জন্য বাবা-মায়ের হাহাকার এখনও থামেনি।
চলতি বছরের ২৫ জানুয়ারি রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বেড়িবাঁধ এলাকায় ‘স্মার্ট ফ্যাশন’ নামে একটি পোশাক কারখানায় ভয়াবহ আগুনে ৭ পোশাক শ্রমিক নিহত হয়। আহত হয় অন্তত আরও ১৫ জন। কারখানাটিতে কাজ করতো প্রায় ৩০০ শ্রমিক। তবে মালিকরা নিহতদের পরিবারকে ১০ লাখ টাকা ক্ষতি পূরণ হিসেবে দিলেও প্রিয় সন্তানকে ফিরিয়ে দিতে পারেনি।
২৪ এপ্রিল রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপ ছিল পোশাক শিল্পের ইতিহাসে সব চেয়ে মর্মান্তিক ঘটনা। এতো মানুষের মৃত্যু, এতো মায়ের কোল খালি হওয়া কিংবা এক সঙ্গে এতো চোখের জল ঝরেনি পোশাক শিল্পে। ভবনের পরতে পরতে বেঁচে থাকা মানুষের আকুতি দেখেছে বিশ্ববাসী। ভারী যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে বেঁচে থাকা মানুষকে বের করার নিরন্তর চেষ্টা ছিল অভাবনীয়।
সবার প্রচেষ্টায় হয়ত বেশি সংখ্যক মানুষকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। তবে নিখোঁজ হওয়া স্বজনদের কাছে তাদের আদরের সন্তানকে ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব হয়নি। কেবল অগত্যা পরিচয়হীন লাশ হিসেবে জুরাইন কবর স্থানে জায়গা হয়েছে হতভাগ্য ঐ সব পোশাক শ্রমিকের। সেই সময়ে ভবনের মালিক রানাকে গ্রেফতার করা হলেও কি বিচার হবে তা কেউ জানে না। এতো কিছুর পরও পোশাক কারখানার হতাহত শ্রমিকদের ক্ষতি পূরণ দেওয়া সম্ভব হয়নি।
রানা প্লাজা ধসের পর মালিকরাসহ একটু নড়েচড়ে বসে দেশি বিদেশি ক্রেতারা। তারা পোশাক কারখানার কর্মীদের কাজের সুষ্ঠু পরিবেশ ও নিরাপত্তার বিষয়টি নিয়ে চিন্তাভাবনা করতে শুরু করে। মার্কিন ক্রেতা জোট অ্যালায়েন্স ফর বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স সেফটি ও ইউরোপিয় ক্রেতা জোট অ্যাকোর্ড অন ফায়ার অ্যান্ড বিল্ডিং সেইফটি ইন বাংলাদেশ নামের এই প্রতিষ্ঠান দুটি এগিয়ে আসে।
তারা কম্প্লায়েন্স ইস্যূতে পোশাকশিল্পে অগ্নি ও ভবন নিরাপত্তার বিষয়ে কারখানাগুলোকে পরিদর্শনের দায়িত্বভার নেয়। তাছাড়া পোশাক কর্মীদের মান উন্নয়ন প্রশিক্ষণে অর্থ ব্যয়ের ঘোষণা দেয়।
এরই মধ্যে পোশাক কর্মীদের ন্যূনতম বেতন ভাতা বৃদ্ধির দাবিতে আশুলিয়া, কোনাবাড়ি, গাজিপুর, নারায়নগঞ্জসহ সাভারে বিক্ষোভ ও রাস্তা অবরোধ করে তারা। এতে নিম্নতম মজুরি বোর্ড ও মালিক শ্রমিক নেতারা বিভিন্ন আলোচনা করে।
এরপর ৪ নভেম্বর নিম্নতম মজুরি বোর্ড ৫ হাজার ৩০০ টাকা ন্যূনতম মজুরি ঘোষণা করে। তবে নানা ছলছুতায় সময় ক্ষেপণের পর ১৩ নভেম্বর সন্ধ্যায় অবশেষে পোশাক শ্রমিকদের জন্য ঘোষিত ন্যূনতম মজুরি কাঠামো মেনে নেয় বিজিএমইএ। এ সময় বোর্ড ঘোষিত ৫ হাজার ৩০০ টাকা ন্যূনতম মজুরি অনুযায়ী, শ্রমিকদের মূল বেতন ধরা হয়েছে ৩ হাজার ২০০ টাকা, বাসাভাড়া ১ হাজার ২৮০ টাকা, যাতায়াত ২০০ টাকা, চিকিৎসা খরচ ধরা হয়েছে ৩২০ টাকা । এছাড়া অন্যান্য খরচ ধরা হয়েছে ৩০০ টাকা।
তবে ঘোষিত মজুরি ৫ হাজার টাকা মেনে নেওয়ার পর ক’দিন যেতে না যেতেই ২৮ নভেম্বর রাতে গাজীপুরের কোনা বাড়িতে আগুনে পুড়ে যায় স্ট্যান্ডার্ড গ্রুরুপের কারখানা। নাশকতার আগুনে ১৭ ঘন্টায় পুড়ে যায় অন্তত ১২০০ কোটি টাকার সম্পদ। অসহায় হয়ে পড়ে কারখানা মালিক ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন।
কারখানার আগুনকে ইস্যূ করে চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতায় পোশাক শিল্পমালিকরা নিরাপত্তার দাবি করে। তাতে মালিকরা সংবাদ সম্মেলন থেকে শুরু করে মানববন্ধন, স্মারকলিপি পেশসহ পতাকা মিছিল করে।
এসময় চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতায় ব্যবসা খাতে কোটি টাকা ক্ষতি হচ্ছে বলে দাবি করে। পোশাক শিল্পে রপ্তানি আদেশ বাতিল ও সহিংসতায় ক্ষতি বেড়ে যাওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন তারা।
এভাবে জীবন-মৃত্যু, হাসি-কান্না, পাওয়া না পাওয়ার বছর ছিল ২০১৩। পোশাক শিল্পে বহু মৃত্যু আর অসংখ্য পঙ্গুত্ব বরণের সাক্ষী এই বছর। তবে নতুন বছরে এমন ১৩ যেন আর না আসে পোশাক শিল্পে। এমনটাই প্রত্যাশা করছেন শিল্প সংশ্লিষ্টসহ দেশের মানুষ।