ভেঙ্গে পড়েছে বিএনপি’র সভাপতি ও ১৮ দলীয় জোট নেতা খালেদা জিয়ার আপোষহীন ভাবমূর্তির খোলস। ভেতরে ভেতরে তিনি যেনো গুটিয়ে যাচ্ছেন, ভেঙ্গে পড়ছেন। বের হয়ে আসছে নমনীয়, দূর্বল অন্য এক খালেদা ছবি। মঙ্গলবার ঘোষিত কর্মসূচি দেখে এমনটাই মনে করছেন অনেকের। যদিও এ কর্মসূচির পর দেশের বেশিরভাগ মানুষ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছেন, তবু তাদের কৌতুহলের শেষ নেই। খালেদা জিয়া কী হঠাৎ বদলে গেছেন, না-কি তিনি দাবার চালে হারতে হারতে তিনি ক্লান্ত-বিধ্বস্ত? মার্চ ফর ডেমোক্রেসি সরকার বিরোধী আন্দোলনে কর্মী-সমর্থকদের উজ্জ্বীবিত করার নতুন কোনো কৌশল নয় তো, যুদ্ধক্ষেত্রে যেমন অনেক সময় পিছিয়ে এসে রণব্যুহ তৈরি করতে হয়?
পাঁচ কারণে বেগম খালেদা জিয়া হঠাৎ নমনীয় হয়েছেন বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লষকরা। এর মধ্যে নানা ব্যর্থতা-ভূল যেমন আছে, তেমনই আছে আন্দোলনের শক্তি সঞ্চয়ের সুপ্ত বাসনাও।
এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে অনমনীয় অবস্থানের কারণে আপোষহীন নেত্রীর অভিধায় অভিষিক্ত হয়েছিলেন বিএনপি নেতা বেগম খালেদা জিয়া। কর্মী-সমর্থকদের গণ্ডি পেরিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যেও গড়ে উঠছিল তার এমন ভাবমূর্তি। এবারের সরকার বিরোধী আন্দোলনেও শুরু থেকে তিনি ছিলেন কঠোর অবস্থানে। তাই জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দুই সপ্তাহেরও কম সময় আগে মঙ্গলবার তার দেওয়া কর্মসূচি দেখে অনেকেই বিষ্মিত। তারা আগের খালেদা জিয়া আর মঙ্গলবারের খালেদা জিয়াকে যেন মিলাতে পারছেন না। টানা অবরোধের পর যখন অআরও কঠোর কর্মসূচি নিয়ে জল্পনা-কল্পনা চলছিল, তখন মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’র মত কর্মসূচিকে অনেকেই খালেদা জিয়া পশ্চাদপসারণ, কেউ কেউ একে নি:শর্ত আত্মসমর্পণ হিসেবে দেখতে শুরু করেছেন।
রাজনীতির দাবায় বারবার ভুল করে সরকারের কৌশলী চালে পিছিয়ে পড়ছে বিএনপি তথা খালেদা জিয়া। তার নের্তৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের সিরিজ কর্মসূচিতে সরকারের অটল অবস্থানের ভিত টলেনি, বরং দূর্ভোগ বেড়েছে সাধারণ মানুষের। স্থবির হয়ে পড়েছে দেশীয় অর্থনীতির চাকা। এর মধ্যেই মঙ্গলবার ২৯ ডিসেম্বরের ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’র কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন। এদিন দেশবাসীকে জাতীয় পতাকা হাতে ঢাকায় আসার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
বিশ্লেষকদের মতে,সরকার বিরোধী আন্দোলনে এ নমনীয়তার প্রধান কারণ সেনাবাহিনীর সঙ্গে সম্ভাব্য সংঘাত এড়ানো। নিবাচনকে সামনে রেখে আগামি ২৬ জুলাই মাঠে নামানো হচ্ছে সেনাবাহিনীকে। যদিও বিদ্যমান গণপ্রতিনিধিত্ব আইনে (আরপিও) সেনাবাহিনীর ক্ষমতা কিছুটা সীমিত, তবুও জ্বালাও–পোড়াও ও ভাংচুরের মত ঘটনায় তারা নির্বিকার থাকবে না বলেই মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। ধরনের ঘটনাকে সেনাবহিনী তাদের মর্যাদার ইস্যুর সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে পারে। আর তেমনটি হল এসব ঘটনার বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিতে পারে। সে ক্ষেত্রে বিরোধী দল ও সেনাবাহিনী মুখোমুখী অবস্থানে চলে আসতে পারে। একে বিপজ্জনক মনে করছেন বিরোধী দলের নেতারা।
বিএনপি নেতার নমনীয় হওয়ার দ্বিতীয় কারণ দলীয় কোন্দল। দীর্ঘদিন ধরেই দলটিতে এ কোন্দল ও মতবিরোধ চলছে। এবার নির্বাচন ও জামায়েত ইস্যুতে তা আরও বড় হয়েছে। দলটির শীর্ষ নেতাদের একটি অংশ কোনোভাবেই জামাতকে সাথে নিয়ে পথ চলায় আগ্রহী নয়। তারা মনে করেন, তার ফলে বিএনপির গায়েও মৌলবাদের তকমা লাগছে। তাছাড়া তাদের মতে, বিএনপির উচিত আরও কিছুদিন ক্ষমতার বাইরে থাকা। কারণ এ মুহূর্তে ক্ষমতায় আসার চেয়ে বিরোধী দলের ভূমিকায় থাকাই বিএনপির জন্য নিরাপদ। ক্ষমতায় এলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ইস্যুতে একটি স্পষ্ট অবস্থান নিতে হবে। জামাত সঙ্গে থাকায় এ বিচার প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া, এমনকি ইতোমধ্যে ঘোষিত রায় কার্যকর করা সম্ভব নয়। আবার জামায়েতের চাপে এ অবস্থান থেকে সরে এলে সাধারণ মানুষ তা মানবে না। এ ইস্যুকে কেন্দ্র করে দেশে ফের গণ আন্দোলন গড়ে উঠতে পারে।
এদিকে দিন দিন জামাতের উপর নিভরশীলতা বাড়ছে। আন্দোলনের লাগাম বিএনপির হাত থেকে ছুটে যাচ্ছে। হরতাল–অবরোধে শিবিরের বেপরোয়া সন্ত্রাস ও নাশকতা নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্চে না। অথচ এসব ঘটনার দায়–দায়িত্ব চাপছে বিএনপির ঘাড়ে। বিএনপি একটি নিষ্ঠুর,নির্মম ও খুনি দল হিসেবে পরিচিতি পাচ্ছে। অন্যদিকে এসব নাশকতার ঘটনায় বিএনপি নেতা–কমীদের বিরুদ্ধে মামলা–মোকদ্দমা হচ্ছে, তাদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। এতে মূলত শক্তি ক্ষয় হচ্ছে দলটির।
টানা–অবরোধের কারণে দেশে জনজীবপন বিপর্যস্ত হয়ে পড়লেও সরকারের খুটি এতটুকু নড়ানো যাচ্ছে না। কিন্তু অথনীতি ধংসের দায় ঠিকই চাপছে বিএনপির ঘাড়ে। ব্যবসা–বাণিজ্য ও অর্থনীতি সম্পর্কে ব্যবসায়ী নেতারা যে বক্তব্য রাখছেন তা বিএনপির বিপক্ষে যাচ্ছে। হরতাল–অবরোধের কারণেই ব্যবসা–বাণিজ্য ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে বলে ব্যবসায়ী নেতারা অভিযোগ করছেন। তাই কঠোর কর্মসূচি দিলে এ সমালোচনা আরও তীব্র হবে, কিন্তু তাতে লক্ষ্য হাসিল তথা নির্বাচন থেকে আওয়ামীলীগকে বিরত রাখা যাবে কি–না তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। তাই হরতাল–অবরোধের মত কর্মসূচি দলের জন্য ঝুঁকিই বাড়াবে শুধু। দূরত্ব তৈরি করবে ব্যবসায়ী–শিল্পোদ্যোক্তাদের সঙ্গে।
তবে কঠোর কর্মসূচির পথ থেকে এ মুহূর্তে সরে আসার সবচেয়ে বড় কারণ দলের নেতা–কর্মীদের মাঠে নামাতে না পারা। বিএনপির শীর্ষ নেতারা মনে করেন, আন্দোলনে চূড়ান্ত সাফল্য পাওয়া গেলে শেষ বিচারে কোনো বদনাম, অপবাদ থাকবে না। কিন্তু সাফল্যের জন্য যে শক্তি নিয়ে মাঠে নামা প্রয়োজন তা পারা যাচ্ছে না। নানাভাবে চেষ্টা করেও আন্দোলনে সম্পৃক্ত করা যাচ্ছে না দলের বড় অংশকে। এমনকি খোদ খালেদা জিয়া ফোনে ব্যাক্তিগতভাবে যোগাযোগ করেও নেতাদের উজ্জীবিত করতে পারেন নি বলে জানা গেছে বিএনপির বিভিন্ন সূত্রে।
নেতারা কথা দিয়েও তা রাখছেন না। অনেক নেতা আবার ম্যানেজ হয়ে গেছেন বলেও সন্দেহ করা হয়। এমন অবস্থায় জোর করে কঠোর কোনো আন্দোলনকে টেনে নেওয়ার চেষ্টা করলে তাতে লোকসানই বাড়বে কেবল।
এমন বাস্তবতায় অনেকটা বাধ্য হয়েই মার্চ ফর ডেমোক্রেসি বা গণতন্ত্রের জন্য অভিযাত্রার মত কমসূচি ঘোষণা করেছেন বিএনপি নেতা। একে একে ঘিরেও কিছু স্বপ্ন ও সুপ্ত বাসনা রয়েছে। প্রথমত যদি সরকার শান্তিপূণভাবে এ কর্সচি পালন করতে দেয় তাহলে নিজেদের শক্তিমত্তা সম্পর্কে আবার একটি ধারণা পাওয়া যাবে। যার আলোকে চূড়ান্ত করা যাবে আন্দোলনের ধরণ। সুযোগ পেলে এ কর্মসূচির আড়ালে হেফাজত ও জামাত–শিবিরের হাজার হাজার কর্মীকে রাজধানীতে জড়ো করা সম্ভব হবে। আর এটি করা গেলে তাদেরকে রাজধানীতে অবস্থান করিয়ে কঠোর কোনো আন্দোলনে যাওয়া সম্ভব। অন্যদিকে সরকার এ কর্মসূচিতে বাধা দিলে তাকে নতুন কর্মসূচির অজুহাত বানানো যেতে পারে।
একদিকে তত্ত্বাবধায়ক ছাড়া নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার স্বিদ্ধান্ত, দলের শীর্ষ নেতাকর্মীরা কারাগারে রুদ্ধ, অন্যদিকে দলের সমন্বয়হীনতা সৃষ্টি করেছে দলের মতানৈক্য। এরপরও বারবার কঠোর আন্দোলনের ডাক দিয়েছিল বিএনপি। দেশের জেলা শহর ও মফস্বলগুলোতে সফল হলেও আন্দোলন রাজধানীসহ বিভাগীয় কয়েকটি শহরে ছিল শিথিল।